দক্ষিণ এশিয়া ও উর্দু-ভাষী বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে ইকবালকে শায়র-ই-মাশরিক (প্রাচ্যের কবি) হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
তিনি তার জাগরণী কাব্যে ও নেতৃত্বে উপমহাদেশের মুসলিমসমাজে পুনর্জাগরণ করে তুলেছিলেন।
মুসলিমদের ঘুমন্ত চেতনা জাগ্রত করেছেন।
আল্লামা ইকবাল ছিলেন নবীপ্রেমের মূর্তপ্রতীক। ইকবাল ইসলামের যে ভাষ্য দাঁড় করিয়ে ছিলেন; রাসূলের প্রতি ভালোবাসা সেই ভাষ্যের প্রধান ভিত্তি। তাঁর মতে, ইসলামের প্রকৃত রূপ শুধু মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও তার পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমেই সম্ভব।
মুসলিমদের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে কবি ইকবাল রাসুলের ভালোবাসা ও তাঁর আদর্শের অনুসরণের কথা বলেছেন।
কবি ইকবালের হৃদয়ে ছিল রাসুল (সা.)-এর প্রতি এবং তাঁর জীবনের জন্য অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। কবি ইকবাল শৈশব থেকেই পিতামাতা ও শিক্ষকদের থেকে নবীপ্রেমের শিক্ষা পেয়েছেন। তখন থেকেই তাঁর হৃদয়ে নবীজির ভালোবাসা গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল।
আল্লামা ইকবালের রাসূল প্রেমের জ্বলন্ত প্রমাণ হিসেবে অনেক ঘটনা বর্ণনা করা যায়। ইকবালের জীবনের শেষ দিনগুলোতে আরব দেশের একজন কারী সাহেব প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তিনি পবিত্র কোরআন থেকে অত্যন্ত সুললিত কণ্ঠে তিলাওয়াত করে কবি ইকবালকে শুনাতেন। একবার তিনি অনুরূপভাবে সুরা মুজাম্মিল তিলাওয়াত করলে ইকবাল এতই অভিভূত হয়ে পড়েন যে চোখ থেকে অশ্রু ঝরে বালিশ পর্যন্ত সিক্ত হয়ে যায়। কারণ এই সুরায় নবীজীর কথা উল্লেখ হয়েছে।
আরেকবার আল্লামা ইকবাল পুত্র জাবিদকে ‘মুসাদ্দেসে হালি’ থেকে আবৃত্তি করে শোনাতে বললেন। বিশেষ করে সে অংশ থেকে পড়তে বলেন, যাতে নিম্নের চরণ দুটি আছে :
‘নবীদের মধ্যে রহমত উপাধী প্রাপ্ত তিনি, তিনি অসহায়দের উদ্দেশ্য পূরণকারী নবী।’
ইকবাল পুত্র জাবীদের মুখে স্তবকটি শুনেন, সঙ্গে উপস্থিত আরেক জন ব্যক্তিও চরণ দুটি পুনরাবৃত্তি করেন, তিনি তখন অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন।
কোরআনে পাক শোনার সময় অথবা রাসুল কারিম (সা.)-এর পবিত্র নাম কারো মুখে উচ্চারিত হওয়া মাত্রই তাঁর নয়নযুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে যেত।
১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘আরমোগানে হিজাজ’। এই কাব্যগ্রন্থে নবীজিকে সম্বোধন করে কবিতা লিখেছেন। রাসুলের প্রতি তাঁর অগাধ ও নিখুঁত ভালোবাসা শব্দের আকার ধারণ করে কবিতার ছন্দে ছন্দে উদ্ভাসিত হয়েছে। এসব কবিতার পঙক্তিতে কল্পনায় রাসুলের রওজার সামনে দাঁড়িয়ে রাসুল (সা.)-কে সালাম নিবেদনের গভীর আকুতি ফুটে ওঠেছে। রাসুল (সা.)-এর জন্মভূমি আরবের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী তাঁর কাছে ছিল অতি প্রিয়। তাঁর এসব কবিতায় মরুভূমি আর খেজুর বৃক্ষের আলোচনা এ কারণেই বার বার এসেছে। রাসুল (সা.)-এর পবিত্র নাম শুনামাত্র তাঁর অন্তর বিগলিত হয়ে যেত। অশ্রু সংবরণ করতে পারতেন না। আল্লামা ইকবাল তাঁর কবিতায় মুসলমানের অন্তরে আল্লাহ তাআলাও নবীপ্রেম জাগিয়ে তুলেছিলেন। ড. আল্লামা ইকবাল বলেন,‘দর দীলে মুসলিম মকামে মুস্তফা আবরুয়ে মা যে নামে মুস্তাফাস্ত।’
অর্থাৎ, মুসলমানদের অন্তরে রাসুলের মর্যাদার স্থান আছে, আর আমরা মুসলমান জাতির মান-সম্মান, তাঁর পবিত্র নামের বদৌলতে আছে।
‘কী মুহাম্মদ সে ওয়াফা তুনে, তো হাম তেরে হ্যায়, ইয়ে
জাহা চিজ হ্যায় কেয়া? লওহ কলম তেরে হ্যায়।’
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যানুবাদে,
‘আল্লাহ কে যে পাইতে চায়, হযরতকে ভালবেসে, আরশ-কুরসী, -কলম না চাহিতে পেয়েছে সে।’
‘মগজে কুরআন, রুহে ঈমান, জানে দ্বীন, হাসত হুব্বে রাহমাতুল্লিল আলামীন।’
‘কুরআনের মগজ, ঈমানের আত্মা, ধর্মের প্রাণ শক্তি হলো প্রিয়নবীর প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসা।’
লেখক : শিক্ষক ও অনুবাদক